১৯৭১ সাল। রেইন ট্রি আচ্ছাদিত ঐতিহাসিক যশোর রোড ধরে অগণিত মানুষের ঢল। সবাই বর্বর পাকবাহিনীর গণহত্যার কবল থেকে বাঁচতে ছুটে চলেছে। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে বর্বর পাকবাহিনীর বর্বরতা শুরু হলে যশোর রোড ধরে নিরস্ত্র বাঙালি সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে যেতে থাকে। সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার অন্যতম মূল পথ হয়ে ওঠে যশোর রোড।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের নয় মাসে ঐতিহাসিক এই যশোর রোড দিয়ে তৎকালীন পূর্ব বাংলার অগণিত মানুষ কলকাতা যান। যুদ্ধের ভয়াবহতায় সবকিছু হারিয়ে শুধু প্রাণটুকু নিয়ে প্রতিবেশী দেশ ভারতের শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিতে চলে তাদের অনিশ্চিত পথচলা। ১৯৭১ সালে অন্তত এক কোটি শরণার্থী পশ্চিমবঙ্গ ও ভারতের সীমান্তবর্তী বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেন। যশোর রোডেও আশ্রয় নেন বহু শরণার্থী।
কবির কথায়, “শত শত মুখ হায় একাত্তর, যশোর রোড যে কত কথা বলে, এত মরা মুখ আধমরা পায়ে পূর্ব বাংলা কলকাতা চলে।”
মার্কিন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গের ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ কবিতায় যেন প্রাণ পেয়েছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ আর যশোর রোড। হৃদয়স্পর্শী ১৫২ লাইনের সুদীর্ঘ এ কবিতায় মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে। অসাধারণ এই কবিতায় অতুলনীয় কাব্যিক ভাষায় কবি তুলে ধরেছেন সেদিনের দুঃসহ যন্ত্রণাকাতর মানুষের অবর্ণনীয় কষ্টের কথা।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত ইতিহাসের বর্বোরচিত পাক হানাদার বাহিনীর গণহত্যা এবং ভারতের বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের অসহায় জীবনের কথা জেনে কেঁদে ওঠে কবির কোমল মন। তিনি স্বচক্ষে সেই দুর্দশার চিত্র দেখার সিদ্ধান্ত নেন।
পশ্চিমবঙ্গের বন্ধুস্থানীয় কবি ও সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়ে শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেন গিন্সবার্গ। সঙ্গে নেন শরণার্থীদের আর্থিক সহায়তা প্রদানের জন্য সংগৃহীত অর্থ। সেপ্টেম্বর মাস, চারদিকে তখন প্রচুর বৃষ্টি, বন্যায় ডুবে গেছে যশোর রোডের বহু অংশ। কিন্তু দমে যাওয়ার পাত্র নন সাত সমুদ্র তের নদী পাড়ি দিয়ে আসা কবি গিন্সবার্গ। নৌকায় চেপে বনগাঁ পেরিয়ে যশোর সীমান্তে গিয়ে সীমান্ত এবং তৎসংলগ্ন শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের অসহায় অবস্থা খুব কাছ থেকে দেখেন কবি।
অসহায় মানুষগুলোর অবর্ণনীয় দুর্দশার চিত্র কবিমনকে ভীষণভাবে আন্দোলিত করে। হাতে তুলে নেন কলম, রচনা করেন মানবতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত কালজয়ী ও অমর কবিতা ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’। কবির সেই কলম কোনো অংশেই যোদ্ধার অস্ত্রের চেয়ে কম শক্তিশালী ছিল না।
শুধু কবিতা লিখেই থেমে যাননি মানবদরদী কবি গিন্সবার্গ। স্বচক্ষে দেখা বাংলাদেশের শরণার্থীদের অবিশ্বাস্য যন্ত্রণার চিত্র আর নিরীহ-নিরস্ত্র মানুষের ওপর পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সীমাহীন নিষ্ঠুরতা ও নির্বিচারে গণহত্যার কথা সারাবিশ্বকে জানানোর জোড়ালো উদ্যোগ নেন তিনি। অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে পাকিস্তানকে সহায়তা করে আড়ালে থেকে যুদ্ধের ইন্ধন যারা জুগিয়েছে তাদের ভন্ডামিও ফাঁস করে দেয়ার উদ্যোগ নেন তিনি। নিঃসন্দেহে বিষয়টি তার জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। কিন্তু নিজ জীবনের মায়ার চেয়ে কোটি মানুষের ওপর চালানো অন্যায় অত্যাচারের কথা বিশ্ববাসীকে জানানোটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছিলেন মহৎ হৃদয়ের কবি গিন্সবার্গ।
‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ কবিতাটি বিখ্যাত দ্য নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পর বিশ্বজুড়ে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে নিন্দার ঝড় ওঠে। নির্বিচারে গণহত্যায় মেতে ওঠায় তাদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করে বিশ্ববাসী।
গিন্সবার্গের কাছের বন্ধু ছিলেন বিখ্যাত বিটলস ব্যান্ডের গায়ক জন লেনন। গিন্সবার্গের কাছে ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ কবিতাটি শুনে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ে জন লেননের শিল্পীমন। চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি জন। তিনি কান্নাভেজা কণ্ঠে বন্ধুকে কবিতাটি থেকে গান তৈরির পরামর্শ দেন।
এরপর আরেক কিংবদন্তী সংগীতশিল্পী ও খুব কাছের বন্ধু বব ডিলানকে সঙ্গে নিয়ে ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ কবিতাকে গানে রূপ দেয়ার কাজ শুরু করেন গিন্সবার্গ। বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য অর্থ তহবিল গঠনের লক্ষ্যে বব ডিলানসহ বিখ্যাত বেশ কয়েকজন সংগীতশিল্পীকে নিয়ে আয়োজিত হয় কনসার্ট। সেখানে বব ডিলানের গিটারের তালে ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ গান পরিবেশন করেন গিন্সবার্গ নিজেই। পরবর্তী সময়ে জন লেননের পরামর্শ অনুযায়ী গানটি রেকর্ড আকারেও প্রকাশের উদ্যোগ নেন গিন্সবার্গ।
এছাড়া নিউইয়র্কের সেন্ট জর্জ গির্জায় আয়োজিত কবিতা আবৃত্তির একটি অনুষ্ঠানে ব্যাপক প্রশংসিত হয় গিন্সবার্গের ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ কবিতাটি।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে যোগাযোগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সড়ক হিসেবে সুপরিচিত যশোর রোড। এই সড়কের ইতিহাস বেশ পুরনো। মুঘল সম্রাট বাবরের সেনানায়ক ও পরবর্তী সময়ে বঙ্গ জয় করে নিজেকে সুরি সাম্রাজ্যের সম্রাট ঘোষণাকারী শের শাহ সুরির অমর এক কীর্তির নাম গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড। এটি সড়ক-এ-আজম নামেও পরিচিত। গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড এশিয়ার অন্যতম প্রাচীন ও দীর্ঘতম সড়ক। এর দৈর্ঘ্য আড়াই হাজার কিলোমিটার বা ১৬০০ মাইল। এর পূর্ব প্রান্তে রয়েছে বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জ জেলায় অবস্থিত সোনারগাঁও এবং পশ্চিম প্রান্তে আফগানিস্তানের কাবুল।
ষোল শতকে নির্মিত সুদীর্ঘ সড়কটি বাংলাদেশের সোনারগাঁও থেকে শুরু হয়ে পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া হয়ে পাকিস্তানের পেশাওয়ারের মধ্য দিয়ে আফগানিস্তানের কাবুল পর্যন্ত বিস্তৃত। গত চার শতাব্দী ধরে ভারত ও পাকিস্তানের অন্যতম প্রধান সড়ক হিসেবে পরিচিত এটি। বঙ্গ দখলের পর ব্রিটিশরা সড়কটির অনেক সংস্কার করে। তবে সংস্কারের আগে সড়কটি মেঠো পথে পরিণত হয়েছিল। যশোর থেকে কলকাতায় যাওয়ার জন্য বিকল্প হিসেবে নৌপথ ব্যবহার করা হতো। যশোর ছিল হিন্দু অধ্যুষিত। সেখান থেকে অনেক হিন্দু নারী গঙ্গাস্নানের উদ্দেশ্যে বনগাঁ হয়ে চাকদহ গঙ্গার ঘাটে যেতেন।
তৎকালীন সময়ে নৌকার মাঝিরা রাজি না হওয়ায় গঙ্গাস্নানে যেতে না পারায় খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দেন যশোরের বকচরের জমিদার কালী প্রসাদ পোদ্দারের মা। তিনি গঙ্গাস্নানে যাওয়ার জন্য যশোর থেকে চাকদহ পর্যন্ত সড়ক তৈরি করতে বলেন ছেলেকে। তখন কালী প্রসাদ সড়ক তৈরির ব্যবস্থা করেন। এজন্য যশোর রোডকে কালী বাবুর সড়কও বলা হয়।